সাহাবিদের কবরস্থান জান্নাতুল বাকি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মক্কা মুকাররমার কবরস্থানের নাম ‘জান্নাতুল মুআল্লা’। আর মদিনা মুনাওয়ারার কবরস্থানের নাম ‘জান্নাতুল বাকি’। এর মূল নাম হলো ‘বাকিউল গারকাদ’। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় থাকা অবস্থায় তার দুধভাই হজরত উসমান ইবনে মজউন (রা.) এর মৃত্যু হয়। সাহাবায়ে কেরাম তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, তাকে কোথায় দাফন করা হবে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, তাকে ‘বাকিউল গারকাদ’-এ দাফন করা হবে। (মুসতাদরাকে হাকিম : ১১/১৯৩)।
এভাবেই এ জায়গা কবরস্থানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে যায়। এবং এখানে সর্বপ্রথম হজরত উসমান ইবনে মজউন (রা.) (নবীজির দুধভাই) কে দাফন করা হয়।

তারপর কবরস্থান তিন দিকেই প্রশস্ত হতে থাকে। এখন তা বিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববির পূর্ব দিকে অবস্থিত। প্রথম দিকে মদজিদে নববি আর বাকির মাঝখানে ‘হারতুত দাগওয়াত’ নামে একটি মহল্লা আবাদ ছিল। যেখনে মদজিদে নববির খাদেমরা তাদের বংশধর নিয়ে বসবাস করতেন। ১৪০৫ হিজরিতে মসজিদে নববি সংস্কারের সময় এ মহল্লাকে অন্য এক জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। এখন এ জায়গা মসজিদে নববির বারান্দা হিসেবেই ব্যবহার হয়। এবং এটার শেষ প্রান্তেই মসজিদে নববির চার দেওয়াল। তারপর ‘আবু জর’ নামে একটা সড়ক। তারপর জান্নাতুল বাকি। কবরস্থানের চতুর্দিকে একটি উঁচু বাউন্ডারি আছে। পশ্চিম দিকে একটি বড় গেট। কবরস্থানে যাওয়ার জন্য একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। ফজরের পর এবং আসরের পর কবরস্থান সবার জিয়ারতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বাইরে পুলিশের লোকজন অবস্থান করে। এবং ভেতরেও শক্তভাবে নজরদারি করা হয়, কোনো ধরনের বেদাতি কাজ শুরু করলে তা শক্ত হাতে দমন করা হয়।

জান্নাতুল বাকির ফজিলতের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, মৃতদের দাফন করার জন্য এটাকে নির্বাচন করে স্বয়ং আল্লাহ পাক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ দিচ্ছেন। নবীজি (সা.) সর্বপ্রথম তার দুধভাইকে দাফন করেন। তারপর তার চাচি হজরত ফাতেমা বিনতে আসাদ (হজরত আলী (রা.) এর আম্মা) কে, তারপর হুজুর (সা.) এর ছেলে হজরত ইবরাহিম (রা.) কে এখানে দাফন করা হয়। তাছাড়াও হুজুর (সা.) এর  তিন মেয়ে হজরত রুকাইয়া (রা.), হজরত জয়নাব (রা.) এবং হজরত উম্মে কলসুম (রা.) এর কবর এখানে বিদ্যমান। এই তিন মেয়েই হুজুর (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। নবীজির মেয়েদের কবর থেকে সামান্য অগ্রসর হলে উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) এবং উম্মুল মুমিনিন হজরত মায়মুনা (রা.) ছাড়া বাকি সব উম্মুল মুমিনিনের কবর মোবারক।

হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) এর ইন্তেকাল হয় মক্কায়। তাই তাকে জান্নাতুল মুআল্লায় দাফন করা হয়। উম্মুল মুমিনিন হজরত মায়মুনা (রা.) এর ইন্তেকাল মক্কা থেকে দশ মাইল দূরে ‘মাকামে সারাফে’ হয়। সারাফ মদিনা দিকে আসতে যে সড়ক পাওয়া যায়, এর পাশেই। এটা আশ্চর্যজনক যে, হজরত মায়মুনা (রা.) এর বিবাহও এ জায়গায় হয়েছিল এবং মৃত্যুও একই জায়গায় হয়। উম্মাহাতুল মুমিনিনের মধ্য হতে স্রেফ উম্মুল মুমিনিন হজরত জয়নাব বিনতে খুজাইমা (রা.) এর মৃত্যু হুজুর (সা.) এর জীবিত থাকাবস্থায় হয়। এবং তিনি নিজ হাতে তাকে দাফন করেন। বাকি উম্মাহাতুল মুমিনিনরা নবীজি  (সা.) এর বিদায়ের পর মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাদের সবাইকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।

এখানেই হজরত আলী (রা.) এর ভাই হজরত আকিল এবং তার ভাতিজা আবদুল্লাহ ইবনে জাফর  তৈয়্যার (রা.) এর কবর। হজরত নাফে (রা.) এবং হজরত ইমাম মালিক (রহ.) এর কবর। তাদের কবর থেকে সোজা বরাবর সামনে বেড়ে কয়েক কদম অগ্রসর হলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহেবজাদা হজরত ইবিরাহিম (রা.) এর কবর। এবং এর কিছুটা দূরে হজরত ওসমান (রা.) এর কবর। এবং এর বিপরীত দিকে হজরত হালিমা সাদিয়া (রা.) এর কবর। এর মধ্যখানে আরেকটি বেড়া এমন যেখানে শুহাদাদের দাফন করা হয়েছে। দরোজা দিয়ে প্রবেশ করে ডান দিকে দেয়ালের বিলকুল নিচে ইসমাঈল ইবনে জাফরের কবর। এবং বাম দিকে হুজুর (সা.) এর ফুফুর কবর।
মূল জান্নাতুল বাকিতে এখন আর দাফন হয় না। সৌদি সরকার এটাকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যথেষ্ট প্রশস্ত করছে। বর্ধিত অংশে সাধারণ সব মুসলমানদের দাফন করা হয়। এদের বেশিরভাগই হাজি। মূলত তারাই তো সৌভাগ্যবান, যারা মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন।

জান্নাতুল বাকির ফজিলত সম্পর্কীয় হাদিস অনেক। এ কবরস্থানের সবচেয়ে বড় ফজিলত হলো নবীজি (সা.) রাতে ঘুম থেকে উঠে এখানে চলে আসতেন। এবং এই কবরস্থানে শায়িত লোকদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত ‘একদিন রাসুল (সা.) (বণ্টনানুযায়ী আমার নির্ধারিত দিনে) পাশে ছিলেন। কিছুক্ষণ থাকার পর যখন দেখলেন আমার চোখের পাতা বুজে গেছে। তিনি আস্তে আস্তে উঠলেন এবং সাবধানতার সঙ্গে দরোজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেলেন। তারপর আবার শান্তশিষ্টভাবে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। আমি উঠে কাপড় পরিবর্তন করলাম। এবং চাদর গায়ে দিয়ে তার পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম। তিনি জান্নাতুল বাকিতে প্রবেশ করে একটি জায়গায় দাঁড়ালেন। অনেক্ষণ ধরে তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই থাকলেন।

তিনবার হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন। তারপর মুখ ঘুরালেন। আমিও মুখ ফিরালাম এবং খুব দ্রুত গতিতে বরং বলা যায় দৌড়ে দৌড়ে এসে ঘরে প্রবেশ করলাম। তারপর ঠিকঠাকভাবে আগের মতো আস্তে করে শুয়ে পড়লাম। আমি ঘরে পৌঁছতে না পৌঁছতে দেখি, তিনিও ঘরে পৌঁছে গেছেন। এসে বলতে লাগলেন, আয়েশা! তোমার কি হলো? তোমার শ্বাস যে ফুপে উঠছে। বললাম, না কিছুই না। বললেন, নিজে বলে দাও, নয়তো আমার সূক্ষ্ম সংবাদদাতা (আল্লাহ) আমায় সব বলে দেবেন। বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা-বাবা আপনার ওপর উৎসর্গ হোক! ঘটনা হলো, এই। বললেন, আচ্ছা! ওই ছায়া তাহলে তোমার ছিল? যেটা আমি ওখানে দেখছিলাম। বললাম, জি হ্যাঁ! বললেন, তোমার সংশয় ছিল, আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার প্রতি অন্যায় করবেন। বললাম, লোক যতই লুকোচুরি করুক না কেন, আল্লাহ তো জেনেই ফেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, কথা হলো, জিবরাইল আমার কাছে আসছিলেন। তিনি আমাকে আস্তে আস্তে ডাকছিলেন, যাতে তুমি বুঝতে না পারো। জিবরাইল আমাকে বলতে লাগলেন, আপনার রব আপনাকে হুকুম করছেন, আপনি (জান্নাতুল) বাকিবাসীর কাছে যাবেন। এবং তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করবেন।’ (মুসলিম : ৯৭৩)।

অন্য এক হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) (আমার বণ্টিত) নির্ধারিত দিন আমার কাছে থাকাবস্থায় রাতের প্রায় শেষাংশে উঠে বাকিতে চলে যেতেন। এবং বলতেন হে মোমিন শহরবাসী! তোমাদের ওপর সালাম বর্ষিত হোক। কালই তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুত বস্তু পাচ্ছো। তোমরা (কেয়ামতের জন্য) বিলম্ব করছ। ইনশাআল্লাহ! আমরাও অচিরেই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। হে আল্লাহ! কাকিবাসীকে মাফ করে দাও।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর (সা.) এরশাদ করেন ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিকে উঠানো হবে সে ব্যক্তি আমি। তারপর আবু বকর, তারপর ওমর, তারপর আহলে বাকি। আমি আহলে বাকির পাশে আসব। তারা আমার সঙ্গে একত্র হবে। তারপর আমি মক্কাবাসীর অপেক্ষা করব। তারা মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি জায়গায় এসে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। (তিরিমজি : ৩৬২৫; মুসতাদরাকে হাকিম : ৩৬৯১)।

লেখক : মুদাররিস, মারকাজুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর